বাংলার মসলিন কাপড় কালের আবর্তে নানা কারণে হারিয়ে গেলেও সম্প্রতি সরকারের একটি বিশেষ প্রকল্পের হাত ধরে পুনর্জাগরণ ঘটেছে এই ঐতিহ্যের। মিলেছে জিআই সনদ। গত ২৮ ডিসেম্বর 2020, ঢাকায় মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। আর উত্তরের নগর রাজশাহীতে চাষ হচ্ছে এই ফুটি কার্পাসের। আর এই মসলিন দ্রুতই বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত হবে।মূলতঃ ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় তৈরি হতো এই নিপুণ কাপড়, যার কাঁচামাল ছিলো ফুটি কার্পাস নামের এক বিশেষ ধরনের তুলা। বিলুপ্তির প্রায় দুই শ বছর পর আবারও ফিরে এসেছে বাংলার ঐতিহ্য মসলিন। আবারও বাংলার হারিয়ে যাওয়া মসলিন বুনতে শুরু করেছেন বাংলার তাঁতীরা।সর্বশেষ ১৮৫০ সালে লন্ডনে প্রদর্শনের ১৭০ বছর পর বাংলাদেশে বোনা হয়েছে ঐতিহ্যবাহি মসলিন শাড়ি। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রায় সাড়ে তিন শ ঢাকাই মসলিন শাড়ি সংরক্ষিত আছে। এক সময় রোম, ফ্রান্সের আভিজাত পরিবারের মহিলাদের আভিজাত্য প্রকাশ পেত মসলিনে ৷ ইউরোপে এই কদরই সর্বনাশ ডেকে এনে দিয়েছিল মসলিন শিল্পীদের কপালে ৷ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মসলিন নিয়ন্ত্রণে করতে তাঁতিদের উপর চড়া হারে কর চাপিয়ে দেয় ৷ প্রচলিত আছে, মসলিন শিল্পীদের আঙুল কেটে দেওয়ার পরে ঢাকাই মসলিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়।গবেষকরা ছয় বছর চেষ্টায় আবারো মসলিন বুনতে সফল হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ঢাকায় মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও পুনরুদ্ধার নামের প্রকল্পটি ২০১৪ সালে হাতে নেয়া হয়েছিল। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। গবেষকদের প্রত্যাশা, এই খরচ আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। ইতিমধ্যে তাঁরা মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করেছেন। একটি শাড়ি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেওয়া হয়েছে।প্রকল্পে সবচেয়ে কঠিন ধাপ ছিলো মসলিনের কাঁচামাল ফুর্টি কার্পাস জাতের তুলা গাছের সন্ধান। ইতিহাস বিশ্লেষণ করে ২০১৭ সালে গাজীপুরের কাপাশিয়ার গ্রামে মেলে ফুর্টি কার্পাস জাতের তুলা গাছ। খবর পেয়ে গবেষকরা গিয়ে তুলার ধরণ দেখে নিশ্চিত হন, এদিয়ে মসলিন কাপড় তৈরি সম্ভব। নতুন করে তৈরি চরকা দিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করা সুতায় ৪০ তাঁতির মসলিন তৈরির প্রশিক্ষণ চলে দুই বছর। আর তাঁতপিট লুম চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ৬ জনকে। এরপরই সফলতার মুখ দেখে প্রকল্পটি।প্রশিক্ষণ পাওয়া ৬ জন তাঁতিকে দিয়ে কুমিল্লার চান্দিনায় ৩০০ থেকে ৪৫০ কাউন্টের সুতা বানানো শুরু হয়। সেই সুতায় সোনারগাঁও-এ বানানো হয় কাপড়। প্রায় ৩০০ বছর পর সেই সুতা দিয়ে তৈরি করা হয় ছয়টি শাড়ি। যারমধ্যে একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়। প্রায় ১০ মাস আগে মসলিনের ৫টি নমুনা দিয়ে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই ঢাকাই মসলিনের জিআই স্বত্বের অনুমোদন পাওয়া গেছে। এতে করে মসলিনের উৎপত্তি, বুনন পদ্ধতি ও সুতা বাংলাদেশের বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। গত ২৮ ডিসেম্বর-2020, এ–সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। প্রকল্পের পরিচালক আইয়ুব আলী আশা করছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এই শাড়ি সর্বসাধারণের জন্য বাজারে আনা সম্ভব হতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খুব শিগগিরই দেশে মসলিনের ব্যাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে। এতে করে বাংলাদেশ পা দেবে মসলিনের নতুন অধ্যায়ে।
ঢাকাই মসলিনের পুনর্জাগরণ এবং ব্যবসার নতুন দ্বার
